ঢাকা মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির ভবিষ্যৎ - ড. মোঃ কামরুজ্জামান


মীর রকিবুল ইসলাম,কুষ্টিয়া প্রতিনিধি photo মীর রকিবুল ইসলাম,কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৬-১-২০২৫ দুপুর ৩:১১
বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। সারা দেশে  ৩ লাখের বেশি মসজিদ রয়েছে। ৩ লাখ মসজিদে প্রায় ৬ লাখ ইমাম ও মোয়াজ্জিন রয়েছেন। দেশে প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এই মাদ্রাসাগুলোতে প্রায় ২০ লাখ আলেম রয়েছেন। আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যাও ছোট বড়ো প্রায় ২০ হাজারের মতো। সেখানেও আলেমের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। দেশে অর্ধ শতাধিক ইসলামী দল রয়েছে। পীরের দরবার সংখ্যা প্রায় একশোর কাছাকাছি। সব মিলিয়ে দেশে প্রায় ৪০ লাখ আলেম রয়েছেন। ফজরের আযান শুনে এদেশের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। আবার ইশার আযান শুনতে শুনতে তারা ঘুমাতে যায়। সব মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিবেশ ধর্মীয় অবহে জড়িত। দেশের অধিকাংশ মানুষ তাই ধর্ম প্রিয়। 
বাংলাদেশ দুইবার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ থেকে একবার এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আরেকবার। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের পেছনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগ কাজ করেছিল। এদেশের অধিকাংশ জনতা মনে করেছিলো, ব্রিটিশ থেকে দেশ স্বাধীন হয়ে পৃথক একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হবে। দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও  সংস্কৃতি ইসলামী ভাবধারায় প্রণীত হবে। ব্যাংক-বীমা, কোর্ট- কাছারি, অফিস- আদালত ইত্যাদি ইসলামের নীতিতে পরিচালিত হবে। কিন্তু তা হলোনা। দেশ নায়কেরা সেকুলারনীতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করলেন। ধর্মহীন ভূমিকায় আত্মনিয়োগ করলেন রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা। ফলে মুসলিম জনতা আশাহত হলেন। বিশেষ করে পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলার জনগণকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে জালেমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। ফলে ১৯৭১ সালে বীর বাঙালি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরে তারা  পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ থেকে ২০২৪-দীর্ঘ ৫৩ বছর। দেশটি পরিচালিত হয়ে আসছিল ধর্মহীন নীতির ভিত্তিতে। বিশেষ করে ২০০৮ থেকে ২০২৪ সময়টি ছিল ভয়াবহ ইসলামবিরোধীনীতির বহিঃপ্রকাশ। তাদের জুলুম ও ফ্যাসিবাদী নীতি পাকিস্তান ও ব্রিটিশদেরকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। আর এ ফ্যাসিবাদের মাস্টার মাইন্ড ছিল শেখ হাসিনা। হাসিনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছিল। শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছিল। তরুণ-তরুণী ও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিল শেখ হাসিনার শিক্ষা নীতি। পৌত্তলিকতার প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। বিধায় পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় ছিল নানা ধরনের মূর্তির ছবি। গুম, খুন ও রক্তের নেশা ছিল তার মজ্জাগত অভ্যাস। তার হৃদয়টি ছিল নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা এবং  পরশ্রীকাতরতায়  ভরা। তার হিংস্রতা চরিতার্থ করতে মাটির নিচে তৈরি করেছিল আয়না ঘর। আয়না ঘর ছিল মাজলুমের আর্তনাদে ভরা এক বিভীষিকাময় জাহান্নাম। ছিল এক ভয়ানক টর্চার সেল। ধর্ম প্রিয় ও দেশপ্রেমিক জনতার দক্ষ নেতৃত্বকে তিলে তিলে হত্যা করা হতো এখানে। শুধু আয়না ঘরই নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল এক একটি আয়না ঘরে পরিণত হয়েছিল। ভয়াবহ আতংকের নগরীতে পরিণত হয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। উন্নয়নের নামে দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছিল। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ একটি ফকিরের দেশে পরিণত হয়েছিল। তার শোষণ এবং নির্যাতনের কারণে দেশের সকল শ্রেণীর জনতা তিক্ত ও বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর অস্ত্রধারী ও লাঠিয়াল ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ ছাত্রজনতা পিষ্ঠ ও অতিষ্ঠ  হয়ে উঠেছিল। অবশেষে পিষ্ট এই ছাত্র জনতা ফ্যাসিবাদকে বিতাড়িত করতে ফুঁসে উঠে। তাদের দীপ্ত শপথ আর বজ্রকণ্ঠ ধ্বনি ফ্যাসিবাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে। ছাত্র জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে কোনোরকম জীবন রক্ষা করে। তার  সাঙ্গ পাঙ্গরাও আত্মরক্ষার্থে ভারতে পাড়ি জমায়।
 
মূলত শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ক্ষমতায় আসীন হয়েই শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এবং বিডিআরের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়। রাক্ষসরানী হাসিনা জাতীয়তাবাদী শক্তির শিকড় উপড়ে ফেলে। ভারত এদেশের ইসলামী শক্তিকে প্রধান শত্রু মনে করে থাকে। 'র' এর সরাসরি হস্তক্ষেপে এদেশের ইসলামী শক্তির মূলোৎপাটন করতে সব আয়োজন সম্পন্ন করে  শেখ হাসিনা। ৫মে ২০১৩ সালে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আলেমদের  সমাবেশে শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী সরাসরি গুলি করে শত শত নিরীহ আলেমদেরকে শহীদ করে। শহীদী দেহগুলোকে জালিম সরকার পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফাঁসি দেওয়া হয়। বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে এক যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি রেখে হত্যা করে। ফ্যাসিবাদী হাসিনা তাঁর বিদায়ের আগ মূহুর্তে অনৈতিকভাব গায়ের জোরে জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করে।
অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে জনরোষের শিকার হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যায়। তাঁর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও আত্মগোপনে চলে যায়। কেউ কেউ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। দেশে অভাবনীয় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। জনমনে অনাবিল এক প্রশান্তি নেমে আসে। দেশব্যাপী মিষ্টি বিতরণ হয়। মত প্রকাশের এক অভিনব ও অভূতপূর্ব ইতিহাস সৃষ্টি হয়। আলেমরা নির্বিঘ্নে তাদের আদর্শ প্রচার করতে থাকে। ভয় ও বাঁধাহীনভাবে আদর্শ প্রচার করতে পেরে তাদের মাঝে এক ধরনের আবেগ ও উচ্ছাস সৃষ্টি হয়। 
 
আলেমদের ব্যাপারে জনমনে একটি স্বপ্ন জাগ্রত হয়। ইসলামী দলগুলোর মাঝে ঐক্যের এক আবহ তৈরি হয়। ময়দানে যেহেতু আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত সেহেতু বিএনপির পরেই জনগণ বড়ো শক্তি হিসেবে ইসলামী শক্তিকে বিবেচনা করতে থাকে। জনগনের ধারণা এই যে, সব ইসলামী দল এক কাতারে এলে এবার তারাই ক্ষমতায় আরোহণ করবে। ইসলামী শক্তির জন্য এটা একটা বড়ো সুযোগ বলে অনেকে মনে করেন। ইসলামী শক্তির মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে গোছানো একটি পুরনো দল। যেকোনো সময়ের চেয়ে এ দলটির গ্রহণযোগ্যতা এখন আকাশচুম্বি। কিন্তু দলটি তাদের এই গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগাতে পারছেনা। তাদের মাঝে বাস্তবতার চেয়ে আবেগ কাজ করছে অনেক বেশি। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিতে তারা অনেক পিছিয়ে। লেখাপড়া, শিক্ষা, গবেষণা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এখন পর্যন্ত কোনো দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। দলের নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক সিলেবাসের বাইরে কোনো বই পড়েননা বললেই চলে। সিলেবাসভূক্ত চটি বইগুলো শুধুমাত্র পড়ার জন্য পড়ে। আধুনিক যুগ সন্ধিক্ষণের চাহিদা পূরণের কোনো সৃজনশীলতা তাদের সিলেবাসে খুব একটা নেই। দলটি না পূর্ণ পলিটিক্যাল, না পূর্ণ ধর্মীয়, না পূর্ণ এনজিও। আল-কোরআন ও আল হাদীসের বিষয়ভিত্তিক নামকাওয়াস্তে কিছু পড়াশোনার ব্যবস্থা সেখানে থাকলেও ইসলামের গভীর পান্ডিত্য সেখানে অনুপস্থিত। দলটির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ আলেমের উপস্থিতি নাই। জামায়াতের বাইরে যেসব ইসলামী দল রয়েছে তাদের অবস্থা আরো করুণ। এসব দল প্রধানত কওমী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। তাদের গন্ডির চৌহর্দি মসজিদ ও মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের অধিকাংশের জীবন জীবিকার প্রধান উৎস হলো যাকাত, ফিৎরা, দান, সাদাকা ইত্যাদি। তাদের অনেককে ফ্যাসিবাদের সমর্থক শক্তি হিসেবে মনে করা হয়। হেফাজতে ইসলাম বেশ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের সমষ্টি। অথচ দলটির নেতারা দলটিকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করেন। এ দাবিটি হাস্যকর বলেই মনে করি। হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন, চরমোনাই একে অপরের সহযোগী সংগঠন। এ সংগঠনগুলো কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। ইসলামী আন্দোলন একটি পীর মুরিদী দরবার। তাদের  জনশক্তির বড়ো একটা অংশ গ্রামের সহজ সরল মানুষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। যাদের অধিকাংশই অক্ষরজ্ঞানহীন। দেশে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কয়েক ডজন দল রয়েছে। তারা পবিত্র কোরআনকে মাখরাজ সহ উচ্চারণ করতে পারলেও কোরআন নিয়ে গভীর অনুসন্ধানী তৎপরতা তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। কোরআন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ সমস্ত ওলামায়ে কেরাম কোরআন থেকে শুধুমাত্র পূণ্য অর্জনের চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাদের সকল দলীয় কর্মকাণ্ড সুন্নাহ ভিত্তিক। আর এক্ষেত্রে তারা জুব্বা, টুপি, পাগড়ি এবং দাড়িকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বেশি। যুগ জিজ্ঞাসার জবাব ও আধুনিক উন্নত জ্ঞান গবেষণা তাদের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। কওমি মাদ্রাসার বাইরে লেখাপড়াকে তারা অঘোষিতভাবে হারাম মনে করেন! একসময়ে এগোষ্ঠীটি রাজনীতিকে হারাম মনে করতেন। সুতরাং এ জাতীয় দলকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় দল হিসেবেই ট্রিট করা যেতে পারে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সামাজিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই। তাদের মধ্যে দলীয় কোন্দল এবং নেতৃত্বের লোভ চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি কওমি সমর্থিত তাবলীগ জামাতের মধ্যে গ্রুপিং এবং মারামারি তাদের নেতৃত্বের লোভকেই হাইলাইট করছে। এ ঘটনায় দেশপ্রেমিক তৌহিদী জনতা আশাহত হয়েছেন। উম্মাহর স্বার্থে যে সময়ে ইসলামী শক্তির ঐক্যের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে ঠিক সে সময়ে তাদের মধ্যে নতুন করে কামড়াকামড়ি ও ফতোয়াবাজি শুরু হয়েছে। এটা স্পষ্টতই আলেমদের নেতৃত্বের লোভের বহিঃপ্রকাশ। জাতীয় জীবনে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। সুতরাং এসব তথাকথিত ইসলামী শক্তি জাতিকে কিছুই উপহার দিতে পারবেনা। তাদের পক্ষে জাতীয় ও সামগ্রিক  বিপ্লব সৃষ্টি করা সম্ভব নয। বর্তমানের সুন্দর সন্ধিক্ষণ আলেমরা যেহেতু কাজে লাগাতে ব্যর্থ সেহেতু আগামী দিনে ইসলামী শক্তির ভবিষ্যৎ মোটেই আশাব্যঞ্জক হবেনা ।
 
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া 

Rp / Rp