সাংবাদিক, সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত'র জন্মদিন আজ

শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক এবং বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রণেশ দাশগুপ্তের ১১৩ তম জন্মদিন আজ। ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি ভারতের ডিব্রুগড়ের সোনারং গ্রামে মামা বাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবার নাম অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত এবং মা ইন্দুপ্রভা দাশগুপ্ত। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামে।
তাঁর পড়াশোনার শুরু পুরুলিয়ার রামপদ পণ্ডিতের পাঠশালায়। এখানে তিন বছর পড়াশোনা করেন। এরপর ভর্তি হন রাঁচি জেলা স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এসময় নিয়মিত পড়তেন ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতি’, ‘বিচিত্রা’, ‘কল্লোল’ প্রভৃতি কাগজ। স্কুল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি উদ্বুদ্ধ হন স্বদেশী ভাবনায়। ১৯২৯ সালে রাঁচি জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য ভর্তি হন বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজে, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে। থাকতেন কলেজ হোস্টেলে। সেখানে ছিল ‘অনুশীলন সমিতি’র শাখা। সক্রিয়ভাবে তিনি যুক্ত হন ‘অনুশীলন সমিতি’র সঙ্গে। কিন্তু কলেজে দীর্ঘদিন ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ায় তাঁকে সহ ১৬ জনকে কলেজ থেকে বহিস্কার করে দেয়া হয়। রণেশ দাশগুপ্ত ফিরে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন সিটি কলেজে। কলেজের রামমোহন রায় হোস্টেলে থাকতেন তিনি। ১৯৩১ সালে তিনি সিটি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। এরপর পিতার ইচ্ছেতেই রণেশ দাশগুপ্ত চলে আসেন বরিশাল। সেখানে আশ্রয় মিলে কবি জীবনানন্দ দাশের পরিবার ‘সর্বানন্দ ভবনে’। তিনি ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ ক্লাশে ভর্তি হন। চলে আসেন বিএম কলেজের হোস্টেলে। এসময় তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন রামকৃষ্ণ মিশন ও শঙ্কর মঠে। কলেজে অন্য অনেক বিপ্লবী বন্ধুদের সাহায্যে তৈরি করেন একটি মার্ক্সীয় গ্রুপ। তাঁদের উদ্যোগেই প্রকাশিত হয় ‘জাগরণী’ পত্রিকা। পরবর্তী সময়ে এই ‘জাগরণী গোষ্ঠী’-ই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বরিশাল জেলা কমিটির শাখায় পরিণত হয়।
এরপর রণেশ দাশগুপ্ত বরিশাল থেকে ফিরে আসেন ঢাকায়। তাঁর পরিবারও তখন ঢাকায়। শুরু করেন সাংবাদিকতা। ১৯৩৮ সালে ২৬ বছর বয়সে ঢাকার ‘সোনার বাংলা’ সাপ্তাহিকের সহকারী সম্পাদকরূপে সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি হয় রণেশ দাশগুপ্তের। অল্প কিছুদিনেই আদর্শের দ্বন্দ্ব ধরে পত্রিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরি করেন। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা মূলত কাজ করতেন শ্রমিকদের সঙ্গে। ঢাকেশ্বরী কটন মিলে শ্রমিকদের মধ্যে লিফলেট বিতরণের মধ্যে দিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত শ্রমিক আন্দোলনে প্রবেশ করেন। পরে তিনি দায়িত্ব পান ঢাকার দিনমজুরদের সংগঠন গড়ে তোলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে আবার কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ পায়। তখন রণেশ দাশগুপ্ত ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে গড়ে তোলেন একটি ইউনিয়ন। তিনি সেই ইউনিয়নে বেশ কয়েক বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠা করা ছিলো রণেশ দাশগুপ্তের অনন্য এক কীর্তি। এই কাজে তাঁর সহযোদ্ধা সঙ্গী ছিলেন বিপ্লবী সাহিত্যিক সত্যেন সেন ও তরুণ কবি ও সাহিত্যিক সোমেন চন্দ। এসময় রণেশ দাশগুপ্ত নবাগত লেখকদের জন্য ‘প্রগতি সাহিত্যের মর্মকথা’ নামে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ওপর উর্দূ ভাষা চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে উঠে তুমুল আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। পার্টির নেতা-কর্মীদের আত্মগোপনে থেকে কাজ করতে হত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও ছিলেন। এসময় রণেশ দাশগুপ্ত পার্টির ডাকে একটি শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে গ্রেফতার হন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। কয়েকদিনের মধ্যে মুক্তি পেলেও একই বছরের ০৭ জুলাই তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। বিনা বিচারে ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কারান্তরালে কাটান। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি চাকুরি নেন ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায়।
১৯৫৭ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। এসময় ঢাকার ৩৫টি আসনের ৩৪টিতেই জয়লাভ করেছিল মুসলিম লীগের প্রার্থীরা। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবার গ্রেফতার হন। মুক্তি লাভ করেন ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জেল থেকে বেরিয়েই যোগ দেন ‘সংবাদ’ পত্রিকায়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে রণেশ দাশগুপ্ত আবার গ্রেফতার হন। জেলের বাইরে রাজপথে তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন অভূতপূর্ব জাগরণ তৈরি করে। এবার জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে। আবার সংবাদে কলাম লেখক হিসেবে যোগ দেন। এসময় বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেনের উদ্যোগে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হলে তার সঙ্গে যুক্ত হন রণেশ দাশগুপ্ত। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় উদীচীর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চে যখন পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে নারকীয় গণহত্যা, রণেশ দাশগুপ্ত তখন পুরান ঢাকার বাসিন্দা। প্রথম কিছুদিন তিনি ঢাকাতেই আত্মগোপন করে থাকেন। পরে চলে যান নরসিংদীর রায়পুরায়। সেখান থেকে পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে ভারতের আগরতলাতে আশ্রয় নেন। রণেশ দাশগুপ্ত বিভিন্ন সভা-সমিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বক্তৃতা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাঁর লেখা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালাতেও অংশ নিতেন মাঝে মাঝে। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন সারাদেশ। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে জাতির জনককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর রণেশ দাশগুপ্তকে দেশ ছাড়তে হয়। আর কোনোদিন তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারেননি। তিনি যখন দেশ ছাড়েন তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর; বেঁচে ছিলেন ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত। এই বাইশ বছর রণেশ দাশগুপ্তের নির্বাসিত জীবন। ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার এক বামপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মী ও ভাষাশহীদ স্বাধিকার মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক রতন বসু মজুমদারের বাসায়। সেখানে কিছুটা সুস্থ হলেও ৩১ অক্টোবর তাঁকে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় পেসমেকার স্থাপনের উদ্দেশে। পেসমেকার সংস্থাপন বেশ নির্বিঘ্নেই হয়েছিল। ৪ নভেম্বর কেবিনে দেয়ার কথা। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর এই মহান বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটে।
দেশ ছেড়ে যাবার পর রণেশ দাশগুপ্তের কোন পাসপোর্ট ছিল না। ভারত সরকারের বহু অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। আবার বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়পত্রও তাঁর নেই। সুতরাং তাঁর শবদেহ দেশে আনার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা তৈরি হয়। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের এম.পি গুরুদাস দাশগুপ্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারত সরকারের অনুমতি পাওয়া গেলেও বাধ সাধে ভারতস্থ বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রদূতাবাস। তারা পাসপোর্টবিহীন রণেশ দাশগুপ্তের শবদেহ বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিবেন না। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর তৎকালীন সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম কথা বলেন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে। অতঃপর বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি পাওয়া গেলো। ফিরে এলো শিল্পী সংগ্রামী রণেশ দাশগুপ্তের শবদেহ। বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আনা হলে প্রথম যশোর উদীচী তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করে। তারপর তাঁর শবদেহ ঢাকায় আনা হয়।
আজ যখন মৌলবাদের ভয়াল থাবায় আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে রণেশ দাশগুপ্তের রচনা সরিয়ে নেয়া হয়, তখন প্রশ্ন জাগে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আমরা কী রেখে যাচ্ছি? সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তের রচনা যদি আমরা নতুন প্রজন্মকে না পড়তে দেই, তাহলে একটি বিভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরির দায়ভার কি আমাদের নিতে হবে না? বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের সামনে যদি এই মহাত্মাদের কর্মময় জীবনের অঞ্জলি তুলে ধরার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নির্মাণ সম্ভব। রণেশ দা’র জন্মদিনে এই প্রত্যয়ই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
রণেশ দাশগুপ্তের মতো আদর্শবাদী,বিপ্লবী, দেশপ্রেমীদের জীবন ও কর্ম অনেক বেশি করে পঠিত ও চর্চার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। পাঠ্যপুস্তকে তাঁদের লেখার সাথে জীবনী সংযুক্ত করলে প্রজন্মের মানস ও মনন গঠনে সঠিক পদক্ষেপটি নেয়া হবে বলে মনে করি।
Rp / Rp
Link Copied